(দার্শনিক কবি জিবরান খলিল জিবরান (৬ জানুয়ারি ১৮৮৩খ্রি. – ১০ এপ্রিল ১৯৩১খ্রি.) তাঁর ‘আন্ নাবি’ (দ্য প্রফেট) বইয়ে ‘বন্ধুত্ব’ সম্পর্কে আধ্যাত্মপূর্ণ যেসব অমীয় বানী প্রদান করেন, তা’ নিম্নে সরল অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো। মূলত ‘আন্ নাবি’ বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র আল মুস্তফা। যিনি ১২ বছর ধরে আরফালিস শহরে বসবাস করে নিজ দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজের অপেক্ষা করছেন। এমনই এক হৃদয় বিদারক বিদায়লগ্নে তাকে ঘিরে রাখে একদল জ্ঞানপিপাসু মানুষ। তিনি পর্যায়ক্রমে জনৈক নারী, কবি, কৃষক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, পান্থশালার মালিকসহ নানা পেশার মানুষের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার দার্শনিকপূর্ণ জবাব দেন।
বন্ধুত্ব সম্পর্কে আলোচনায় দেখা মেলে জনৈক যুবককে। যিনি আল মুস্তফা ছদ্মনামের কবি জিবরানের দিকে এগিয়ে এসে ‘বন্ধুত্ব’ সম্পর্কে জানতে চান।)
একজন যুবক এসে বললো, বন্ধুত্ব বিষয়ে তুমি আমাদেরকে কিছু বলো। উত্তরে তিনি বললেন: তোমার প্রয়োজনে তুমি যার সাড়া পাও, সে-ই তোমার প্রকৃত বন্ধু। বন্ধু তোমার ফসলের মাঠ। যেখানে তুমি ভালোবেসে বীজ বপন করো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফসল তোলো। বন্ধু তোমার ভোজসভা এবং জ্বলন্ত উনুন। কারণ, তুমি ক্ষুধা নিয়ে তার কাছে আসো এবং তার কাছে উষ্ণতা খুঁজে পেতে চাও।
*******
তোমার বন্ধু যখন তোমাকে মনের কথা বলে, তখন তুমি সে কথায় তোমার আপত্তি প্রকাশ করতে বা তোমার মনের সম্মতি জানাতে সংকোচ করো না। কারণ, পর্বতারোহীর কাছে পর্বতটি দূরবর্তী সমভূমির চেয়ে অধিক স্পষ্ট ও বড় মনে হয়। তোমার বন্ধু যদি নীরব থাকে। কথা না বলে। তবুও তোমার হৃদয় তার হৃদয়ের কথা শোনা বন্ধ করবে না। কারণ, বন্ধুত্বের সকল ভাবনা, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার বিকাশসাধনে শব্দমালা বা বাক্যসমষ্টির প্রয়োজন হয় না। বরং বন্ধুরা সব বেশ আনন্দের সাথে বন্ধুত্বের পাকা ফল সংগ্রহে একাট্টা হয়ে থাকে। যদি তুমি তোমার বন্ধু ছেড়ে যাও, তবে তার বিচ্ছেদে ব্যাথিত হবে না। কারণ, তোমার বন্ধুর যে গুনটিতে তুমি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট। তার উপস্থিতির চেয়ে অনুপস্থিতিতে হয়তো তা’ তোমার ভালোবাসার দৃষ্টিতে আরো স্পষ্ট হতে পারে।
তোমার আত্মার গভীরতা বৃদ্ধি করা ছাড়া বন্ধুত্বে যেনো তোমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকে। কারণ, যে ভালোবাসা নিজ রহস্য উদ্ঘাটন ছাড়া অন্য কিছু পাওয়ার আশা করে, তা’ ভালোবাসা নয়। বস্তুত তা’ জীবন সাগরে ছুড়ে দেওয়া এক জাল, যাতে কেবল মূল্যহীন জিনিসই ধরা পড়ে। তোমার সর্বোত্তম যা আছে, তাই তুমি তোমার বন্ধুর জন্য স্বযত্নে রাখো।
যদি তোমার হৃদয়ের ভাটার খবর তাকে একান্তই জানাতে হয়, তবে তুমি তাকে জোয়ারের খবরও জানিয়ে দিও। এধরায় তোমার অবসর সময় কাটানোর জন্যই কি তুমি বন্ধুর আশা করো? বরং তুমি তোমার দিন-রাত মূল্যবান সময়কে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বন্ধুর অন্বেষণ করো। কারণ, তোমার প্রয়োজন পুরণ করাই বন্ধুর কাজ। তোমার শূণ্যতা পুরণ করা নয়। পারস্পারিক আনন্দভোগ ও হাস্যরসে বন্ধুত্বের মাধুর্য থাকবে সমুন্নত। কারণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোর বিন্দু বিন্দু শিশিরে হৃদয় তার প্রভাত খুঁজে পায়। অতপর তা’ সতেজ হয় এবং শক্তি ফিরে পায়।
লেখক পরিচিতি
জিবরান খলিল জিবরান (৬ জানুয়ারি ১৮৮৩ খ্রি. – ১০ এপ্রিল ১৯৩১ খ্রি.) একজন দার্শনিক কবি, কথাসাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক পন্ডিত, চিত্রশিল্পী ও সাহিত্য সংগঠক। প্রতীকী ও রোমান্টিক সাহিত্যধারার অন্যতম প্রবক্তা। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় সমপারদর্শী। আধুনিক আরবি সাহিত্যে ‘গদ্যকাব্য’ ধারা প্রবর্তনের অন্যতম অগ্রনায়ক। প্রবাসী সাহিত্য সংগঠন ‘নিউইয়ার্ক কলমলীগ’ (রাবিতাতুল কলাম ফি নিউইয়ার্ক) এর অন্যতম সদস্য। তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘আন্ নাবি’ (দ্য প্রফেট) নামের বইটি লিখে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এটি বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকানুসারে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। বইটি ১১০টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অনুবাদক পরিচিতি
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। তরুন লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। শিক্ষা: বি.এ (অনার্স), এম.এ (আরবি সাহিত্য), এম.ফিল (আরবি শিশুসাহিত্য), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। কাতার প্রবাসী। পেশা: অনুবাদক। ই-মেইল: [email protected]